কিভাবে বাইসাইকেলের সঠিক যত্ন নিবেন

প্রিয় বাইসাইকেলটির পার্ফরমেন্স যখন হঠাৎ করেই খারাপ হয়ে যায় এর চাইতে বিড়ম্বনা আর কিছু নেই। সঠিকভাবে যত্ন না নেয়ার কারণেই আসলে এই অবস্থা হয়। অথচ সাধারণ কিছু নিয়ম মেনে চললেই আমরা আমাদের সাইকেলকে অনেক বছর পর্যন্ত নতুনের মতোই রাখতে পারবো।

সাইকেল নতুন হোক কিংবা পুরোনো, দামী কিংবা কমদামী, ব্রান্ডের কিংবা নন-ব্রান্ড, নিয়মিত সাইকেলের পরিচর্যা না করলে যে কোন সাইকেলেরই গতি, চালানোর সাবলীলতা ও পারফর্মেন্স কমে যাবে। আর সাইকেলে এরকম সমস্যা দেখা দেয়ার পর কেমন লাগে সেটা আশা করি একজন সাইক্লিস্ট হিসেবে নিজেই বুঝতে পারছেন। তাহলে কিভাবে আমরা আমাদের এতো শখের জিনিসের সঠিক যত্ন নিবো? এই পোস্টে এই বিষয়েই আলোচনা করবো।

১। নিয়মিত সাইকেল ওয়াশ ও পরিষ্কার করা

একদম সাধারণ বিষয় দিয়েই শুরু করা যাক,সেটা হলো নিয়মিত ন্যাকড়া দিয়ে সাইকেল মুছে রাখা এবং সাইকেল ওয়াশ করা। নিয়মিত বলতে এখানে বুঝানো হচ্ছে-
  • প্রতিদিন সাইকেল চালানোর পর দিনশেষে একবার ন্যাকড়া দিয়ে পুরো সাইকেলটি মুছা। বিশেষ করে সাসপেনশনটা ভালো করে মুছে নিবেন।
  • যদি শুকনো রাস্তায় এবং শুকনো মৌসুমে রাইড করেন তাহলে মাসে কমপক্ষে ১ বার সাইকেল ওয়াশ, সেটা নিজে করুন কিংবা দোকানে করান।
  • অপরদিকে যদি বর্ষা মৌসুমে রাইড করেন তাহলে সপ্তাহে কমপক্ষে ১ বার সাইকেল ওয়াশ করুন। তাছাড়া লং রাইড দেয়ার পর অবশ্যই সাইকেল ওয়াশ করবেন। কারণ কাদাযুক্ত সাইকেল পরিষ্কার না করলে খুব তাড়াতাড়ি বিভিন্ন যন্ত্রাংশে জং পড়ে যাবে।



২। সাইকেলের চাকায় বাতাস ঠিকঠাক রাখা

কিভাবে বাইসাইকেলের সঠিক যত্ন নিবেন বাতাস চেক করা

আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, বেশিরভাগ সাইকেলের বাতাসই ১০/১২ দিনের মধ্যে এতোটাই কমে যায় যে মনে হবে চাকা লিক হয়েছে। এর কারণ সাইকেলের চাকা বাতাস ধরে রাখতে ১০০% কার্যকরী নয়। তাই কয়েকদিন পর পর আঙ্গুল দিয়ে টিপেই চাকার বাতাস সম্পর্কে একটা ধারণা নিন। সাধারণ হলেও এটি অনেক জরুরী বিষয়, কিন্তু অনেকেই এই জিনিসটা খেয়াল করেন না।

সাইকেলের চাকার বাতাস কম থাকলে বাইকের গতি অনেকটাই কমে যাবে এবং সাইকেল চালাতে অনেক জোর লাগবে। তাছাড়া চাকায় প্রয়োজনের চেয়ে কম বাতাস থাকলে চাকা পাংচার হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়।
অপরদিকে চাকায় প্রয়োজনের অধিক বাতাস থাকলে সাইকেল চালানোর সময় অতিরিক্ত বাম্পিং (লাফানো) করবে এবং তাতে স্বাভাবিকভাবেই এক্সিডেন্টের সম্ভাবনা বেড়ে যাবে।

তাহলে আমাদেরকে সাইকেলের চাকায় যতোটুকু প্রয়োজন ততোটুকু বাতাসই রাখতে হবে, খুব বেশি কিংবা খুব কম দেয়া যাবেনা। পরিমান মতো বাতাস থাকলে চাকা পাংচার হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়, তাছাড়া এবড়ো থেবড়ো রাস্তায় সাইকেল চালালে চাকার বাতাস ঠিক মতো থাকার কারণে সাইকেলের অন্যান্য পার্টস এর ক্ষতি হবে না।

তাহলে চাকায় ঠিক কতোটুকু বাতাস প্রয়োজনীয়?

বিভিন্ন সাইকেলে টায়ার প্রেসার ভিন্ন ভিন্ন হয়। সাইকেলের চাকাতেই লিখে দেয়া থাকে এই টায়ার কোন রেঞ্জের মধ্যে প্রেশার সহ্য করতে পারবে। 
সাধারণত একটি মাউনটেন বাইকের টায়ারে ২৫-৫০ পিএসআই বাতাস দেয়া হয়, আর রোড বাইকে ৬০-১২০ পিএসআই। তবে রাইডের ধরণ, রাস্তার কন্ডিশন, টায়ার, রাইডারের ওজন, ইত্যাদির ওপর নির্ভর করে আপনাকে এই রেঞ্জের মধ্যে থেকেই প্রেশার কম বেশি করতে হতে পারে।

  • রাস্তা - স্মুথ রাস্তায় চালানোর জন্য টায়ার প্রেশার বেশি রাখা ভালো, অপরদিকে রাফ এবং অমসৃণ রাস্তায় কিছুটা কম প্রেশার রাখা উচিৎ।
  • টায়ার - টায়ার যতো চেপ্টা হবে, প্রেশারও ততো কম রাখতে হবে। উদাহরণস্বরূপ - মাউন্টেন বাইকের টায়ার চেপ্টা হওয়ার কারণে এতে প্রেশার কম রাখতে হয়, এবং রোড বাইকের টায়ার চিকন হওয়ার কারণে এতে প্রেশার বেশি রাখতে হয়।
  • ওজন - রাইডারের ওজন যতো বেশি হবে, এই ওজন সাপোর্ট করার জন্য টায়ার প্রেশারও সামানুপাতিকভাবে বাড়াতে হবে।
  • আবহাওয়া - সাধারণত বৃষ্টির মধ্যে রোড অনেক পিচ্ছিল হয়ে যায়। তাতে স্লিপ করার সম্ভাবনাও বেড়ে যায়। তাই মেঘলা দিনে টায়ার প্রেশার অল্প কমিয়ে নিলে তাতে পিচ্ছিল রাস্তায় টায়ারের গ্রিপ কিছুটা বাড়বে।

চাকায় বাতাস দেয়ার জন্যে অনেক ধরণের পাম্পার বাজারে কিনতে পাওয়া যায়, অথবা যে কোন টায়ারের দোকানে ৫ টাকায় বাতাস দেয়া যাবে। তাছাড়া প্রেশার মাপার জন্য নিজেই একটি প্রেশার গজ কিনে নিতে পারেন। আপনার সাইকেল এর টিউব এ যদি মিটার দিয়ে মাপার ব্যবস্থা থাকে না সেক্ষেত্রে হাত দিয়েও টিপে চাকার বাতাস পরীক্ষা করতে পারেন।

টায়ারে বাতাস দেয়ার সময় পেছনের চাকা থেকে সামনের চাকায় বাতাস কিছুটা কম রাখবেন। কারণ সাইকেলের লোড পেছনের চাকা থেকে সামনের চাকায় কম পড়ে। তাই এই লোডের পার্থক্য হিসেবে রেখে সামনের চাকায় বাতাস কিছু কম দেয়া উচিৎ।

৩। লুব্রিক্যান্টস ব্যবহার

কিভাবে বাইসাইকেলের সঠিক যত্ন নিবেন চেইন লুবিং

বাইসাইকেল একটি মেশিন, এবং একটি ইঞ্জিনের মতোই এর বিভিন্ন পার্টস খুব দ্রুত নড়াচড়া করে। এই সময় ঘর্ষণের ফলে অনেক যন্ত্রাংশ ক্ষয় হতে শুরু করে। কিন্তু লুব্রিক্যান্টস ব্যবহারের মাধ্যমে এই ক্ষয় অনেকটাই রোধ করা যায়। একই সাথে যন্ত্রাংশগুলোর মুভমেন্টও অনেক স্মুথ হয়।


সাইকেলের যেসব পার্টস এ সাধারণত লুবিং ও গ্রিজিং এর প্রয়োজন হয় সেগুলা হলো - ড্রাইভট্রেইন (চেইন, ক্যাসেট, চেইন রিং, ডেরা), সাসপেনশন ও ক্যাবল। কিছু কিছু পুরোনো বাইকের ক্ষেত্রে বটম ব্রাকেট ও হাবের ভেতরেও গ্রিজিং করতে হয়।

ড্রাইভট্রেইন লুবিং বাসায় নিজে নিজেই করা যায়, কিংবা সাইকেল সার্ভিসিং এর দোকানেও করা যাবে। নিয়মিত লুবিং করলে সাইকেল সাবলীল ভাবে চলবে এবং জং ধরবে না।

ড্রাইভট্রেইন লুবিং এর দু'টি ধাপ

  1. ময়লা পরিষ্কার - এর জন্য কেরোসিন ব্যবহার করা যেতে পারে। একটা ব্রাশের মাধ্যমে চেইনে ও ক্যাসেটের ময়লা কেরোসিন দিয়ে সাফ করুন ভালো মতো। তারপর একটি ন্যাকড়ার মাধ্যমে কেরোসিন মুছে নিন যাতে আর কেরোসিন না থাকে।
  2. লুব দেয়া - তারপর চেইনে লুব্রিক্যান্ট হিসাবে সেলাই মেশিনের তেল ব্যবহার করতে পারেন। সেলাই মেশিনের তেল খুবই সহজলভ্য এবং দামও কম। তবে সাইকেলের জন্য তৈরি আলাদা লুব্রিক্যান্ট যদি আপনার আশেপাশে সাইকেল শপে থাকে তাহলে সেটা কিনতে পারেন। তবে দু'টোই কাজ একই দিবে। সবশেষে আরেকবার ন্যাকড়া দিয়ে চেইন মুছে নেন। 
আপনি যদি বাইসাইকেল সার্ভিসিং এর দোকানে ড্রাইভট্রেইন লুবিং করাতে চান তাহলে খরচ পড়বে ১০০-১৫০ টাকা। এছাড়াও আজকাল ৩০০-৪০০ টাকায় ফুল সাইকেল লুবিং ও গ্রিজিং করানো যাচ্ছে।

লুবিং করার সময় খেয়াল রাখবেন যাতে কোন অবস্থাতেই ডিস্ক ব্রেকে তেল বা লুব না পড়ে, তাহলে ব্রেকের কার্যকরিতা একেবারেই কমে যাবে।

৪। নাট-বল্টু টাইট রাখা

বেশিদিন চালানোর পর সাইকেলের অনেক নাট-বল্টু লুজ হয়ে যেতে পারে। তাই মাসে একবার অন্তত চেক করা উচিৎ সব নাট-বল্টু টাইট আছে কি না।

নাট-বল্টু লুজ থাকলে এক্সিডেন্টের সম্ভাবনা তো আছেই। এছাড়াও চালানোর সাথে সাথে বিভিন্ন পার্টস ধাক্কা খেয়ে ভেঙ্গে যেতেও পারে।

তবে অতিরিক্ত টাইট দেয়া থেকেও বিরত থাকবেন। এতে পরবর্তিতে খুলতে অনেক অসুবিধা হবে, একই সাথে বেশি টাইট দিতে গিয়ে নাটের থ্রেড নষ্ট হয়ে যেতে পারে।

৫। সাইকেলের ব্রেক নিয়মিত চেক করা

নিয়মিত ব্যবহারের ফলে সাইকেলের ব্রেক প্যাড ধীরে ধীরে ক্ষয় হয়ে যায়। একটা পর্যায়ে এসে ব্রেক প্যাড অতিরিক্ত ক্ষয় হয়ে গেলে তখন সেটা হার্ড ব্রেকিং এর সাথে সাথে রটর এর ক্ষতি করতে পারে, যেটা আপনি চাইবেন না। কারণ রটর পরিবর্তন অনেক খরচ সাপেক্ষ।

তাই মাসে একবার অন্তত ব্রেক প্যাড চেক করুন। এবং ব্রেক প্যাড লিমিট এর বেশি ক্ষয় হওয়ার আগেই পরিবর্তন করে নিন।

সাইকেলের ব্রেক শো কখন পরিবর্তন করতে হয় - কিভাবে বাইসাইকেলের সঠিক যত্ন নিবেন



৫। সাইকেলে শব্দ হলে সতর্ক হোন

সাইকেলের কোন পার্টস থেকে যদি শব্দ আসে তাহলে বুঝতে হবে কোথাও না কোথাও কোন সমস্যা আছে। অনেকেই এই রকম ছোট খাটো শব্দ এড়িয়ে যাই। কিন্তু পরবর্তিতে এর থেকেই বড় কোন সমস্যা তৈরী হতে পারে।

তাই যদি দেখেন এরকম কোন শব্দ হচ্ছে তাহলে এর কারণ খুঁজে বের করুন এবং দ্রুত এর সমাধান করুন।

৬। নিয়মিত সার্ভিসিং করানো

আপনি সাইকেল সাবধানে চালানোর পরও সাইকেলে কোন না কোন সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাই ২/৩ মাস পর পর সাইকেল ফুল সার্ভিসিং করানো উচিৎ।

তাছাড়া সাইকেলের মেনটেনেন্সের কিছু কিছু কাজ আছে যেগুলো নিজে বাসায় করা কষ্টকর, যেমন- চাকার টাল ভাঙানো, গিয়ার টিউনিং ইত্যাদি। নিজে না পারলে অবশ্যই মেকানিকের কাছে নিয়ে যাবেন।

৭। নিজের সাইকেল শুধুমাত্র নিজেই ব্যবহার করুন

কথাটা শুনতে যতো স্বার্থপরই শুনাক, আপনার সাইকেলের জন্য যদি ভালোবাসা থাকে তাহলে নিজের সাইকেল কখনোই অন্যকে ব্যবহারের জন্য দেবেন না। কথায় আছে "সাইকেল আর বউ কখনো অন্যের জিম্মায় দিতে নেই"।

আপনার সাইকেলকে শুধুমাত্র আপনিই বুঝবেন, অন্য কেউ না। আপনি বছরের পর বছর নিজে সাইকেল চালাতে পারবেন কোন মেজর সমস্যা ছাড়া, কিন্তু একদিনের জন্য অন্যের কাছে দিলেই এটা প্রায় নিশ্চিত করে বলতে পারি যে সে সাইকেলে কয়েকশত টাকার কাজ ধরিয়ে আপনাকে ফেরত দিবে। সুতরাং কেউ রাগ করলে করুক, সাইকেল কখনোই অন্যকে দিবেন না।

৮। নিয়মিত সাইকেল চালান

সবশেষে বলবো, সাইকেল একটা মেশিন, নিয়মিত ব্যবহারে ভালো থাকবে, ফেলে রাখলে নষ্ট হবে। তাই নিয়মিত সাইকেল চালালেই এটি ভালো থাকবে। তাছাড়া শরীরের জন্যও সাইকেল চালানো অনেক উপকারী।

হিসেব করে দেখুন, সাইকেলের এইসব যত্ন নেয়া কিন্তু খুব বেশি খরচসাপেক্ষ ব্যাপার নয়। কিন্তু অবহেলার কারণে সাইকেলে বড় কোন সমস্যা দেখা দিলে, কিংবা কোন পার্টস নষ্ট হয়ে গেলে বিশাল পরিমান অর্থ ব্যয় করতে হবে। সাথে হয়রানি তো আছেই। আর তাছাড়া আপনার সাইকেলটি যে পরিমাণ গাড়ি ভাড়া আপনাকে বাঁচিয়ে দিচ্ছে সে হিসেবে এই সামান্য যত্নটুকু কি তার প্রাপ্য নয়?


Post a Comment

0 Comments