সাইক্লিং-এ ইনজুরি এবং এর সমাধান

শরীর সুস্থ রাখার জন্য সাইক্লিং সবথেকে ভালো ব্যায়ামগুলোর মধ্যে অন্যতম। কিন্তু অসাবধানতা কিংবা অসচেতনতার দরুন এই সাইক্লিং-ই হতে পারে আমাদের ইনজুরির কারণ। তবে কিছু সাধারণ নিয়ম মেনে চললেই কিন্তু আমরা এই ইনজুরিগুলো এড়িয়ে চলতে পারি।

এই পোস্টে আমরা আলোচনা করবো কিভাবে কিভাবে সাইক্লিং এর সময় ইনজুরি হতে পারে, এবং কী কী নিয়ম মেনে চললে আমরা এগুলো থেকে বাঁচতে পারবো।

সাইক্লিং ইনজুরি ও তা এড়ানোর উপায়

ইনজুরি অনেক ভাবেই হতে পারে। সাধারণত এক্সিডেন্ট করেই বেশিরভাগ ইনজুরি হয়ে থাকে। তবে এক্সিডেন্ট ছাড়াও অনেক সময় সঠিকভাবে সাইকেল না চালানোর কারণেও অনেক ইনজুরি হয়।

একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে মাত্র ৭% বাইসাইকেল ইনজুরি অন্য সাইক্লিস্ট এর সাথে ধাক্কা লাগার কারণে হয়ে থাকে। তারমানে বেশিরভাগ ইনজুরি-ই হয়ে থাকে পড়ে গিয়ে, অন্যান্য গাড়ির সাথে ধাক্কা লেগে, কিংবা সঠিক নিয়মে সাইকেল না চালানোর জন্য।

বাইসাইকেল এক্সিডেন্ট

সাধারণত আমরা ইনজুরি বলতে বুঝি এক্সিডেন্টে ইনজুরি। নতুন সাইক্লিস্টরা বেশিরভাগই অভিজ্ঞতার অভাবে নানা ভাবে এক্সিডেন্ট করে আহত হোন। তবে অনেক সময় অভিজ্ঞ সাইক্লিস্টরাও অনেক সময় এক্সিডেন্ট এর সম্মুখীন হোন।


কিছু কিছু সময় এক্সিডেন্টে নিজের চাইতে অন্য চালকের দোষ বেশি হয়ে থাকে। কিন্তু প্রায় ৯৫% এক্সিডেন্টের ক্ষেত্রেই কিছু সাধারণ নিয়ম মানলে ক্ষয়-ক্ষতি অনেকটাই কমানো যায়, কিংবা দূর্ঘটনা এড়ানো যায়, এমনকি অন্য ড্রাইভারের দোষ থাকা সত্তেও।

বাইসাইকেল এক্সিডেন্ট এড়ানোর সাধারণ কিছু নিয়ম

  1. হেলমেট পড়া, সেটা পাড়ার দোকানে যাওয়ার সময়ও- হেলমেট এমন একটা জিনিস যা আপনার জীবন ও মরণের মধ্যে লাইন এঁকে দিতে পারে। তাই হেলমেটের ব্যাপারে একদম অবহেলা করা যাবেনা।
    অনেক সময় কাছাকাছি দূরত্বে যাতায়াতের ক্ষেত্রে আমরা মনে করি যে এট্টুকু রাস্তা হেলমেট না পড়লেও হবে। কিন্তু বিপদ ঘটতে কয়েক সেকেন্ড এর বেশি প্রয়োজন হয়না। সুতরাং হেলমেটের ব্যাপারে কোন কম্প্রমাইজ নয়।
  2. রাতের বেলা যথাযথ লাইট ব্যবহার করা- রাতে বাইসাইকেল এক্সিডেন্ট অনেক মারাত্মক হতে পারে। তাই রাতে সাইক্লিং এর অভ্যাস থাকলে যথেষ্ট আলো ব্যবহার করা অতি গুরুত্বপূর্ণ
    অন্যান্য যানবাহনে হেডলাইট ও টেইললাইট থাকলেও বাইসাইকেলে এগুলো আলাদাভাবে কিনে লাগাতে হয়। এ কারণে অনেকেই আমরা লাইট ব্যবহার করি না। কিন্তু নিজের ভালোর জন্যই রাতে সাইকেল চালানোর সময় আমাদেরকে হেডলাইট ও টেইললাইট ব্যবহার করতে হবে।
  3. হঠাৎ মুভমেন্ট না করা- সাইকেল চালানোর সময় কখনোই হঠাৎ করে মোড় নেয়া কিংবা ব্রেক করা, এসব করা যাবেনা। অনেক সাইক্লিস্ট আবার সাপের মতো এঁকেবেঁকে সাইকেল চালাতে খুব পছন্দ করেন, এসব করা যাবেনা। রিকশা বা অন্যান্য স্লো কোন যানবাহনকে অভারটেক করার সময় হঠাৎ করে ডানে চাপা যাবেনা, সামনের গাড়ি যদি হঠাৎ করে ব্রেক করে এর পরেও না।
    এক কথায় আপনি এমন কোন মুভমেন্ট করবেন না যা অন্য ড্রাইভার আগে থেকে বুঝতে পারে না। ব্রেক করতে হলে পেছনে কেউ আছে কি না দেখে ব্রেক করুন, মোড় নিতে হলেও পেছনে দেখে মোড় নিন।
  4. নিজের উপস্থিতি আশেপাশের সবাইকে জানান দেয়া- অন্য চালক আপনাকে যাতে খেয়াল করে সেই ব্যবস্থা আপনাকে করতে হবে। সেটা অনেক ভাবেই করতে পারেন, যেমনঃ হেডলাইট টেইললাইট জ্বালিয়ে, রিফ্লেক্টর ব্যবহার করে, বেল বাজিয়ে কিংবা হাতের ইশারায় সিগনাল দিয়ে। এর ফলে দূর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা অনেকটাই কমে যাবে।

চালানোর ত্রুটির কারণে ইনজুরি ও সমাধান

আগেই বলছিলাম, সঠিক নিয়মে সাইকেল না চালালে শারীরিকভাবে ইনজুরিতে পরতে পারেন। উপরে উল্লিখিত নিয়ম ছাড়াও ভুল স্টাইলে সাইকেল চালানোর এর কারনেও অনেক সময় শরীরে ব্যাথা, মাসল ইনজুরিসহ অনেক ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারেন। এরকম কিছু ইনজুরি সম্পর্কে আলোচনা করা যাক-
  • হাঁটুর ইনজুরি- এই ধরনের ইনজুরি নতুন সাইক্লিস্টদের ক্ষেত্রে বেশি কমন। সাধারণত পায়ে অতিরিক্ত প্রেশার পরার কারণে হাঁটুতে ইনজুরি হয়ে থাকে।
    সমাধান- হাঁটুর ইনজুরি রোধে সব থেকে কার্যকরী পদক্ষেপ হলো সঠিক পজিশনে সাইকেল চালানো। সাইকেলের সিট হাইট যাতে বেশী নিচু বা বেশী উঁচু না হয়, কারন অতিরিক্ত নিচু কিংবা উঁচু সিটে বসে সাইক্লিং করার সময় হাঁটুতে প্রেশার অনেক বেশি পড়ে। সিট নিচু থাকলে হাঁটুর সামনের দিকে ব্যাথা করবে, অপরদিকে সিট উঁচু থাকলে হাঁটুর পেছনের দিকে ব্যাথা করবে।
    তাছাড়া স্পিড কম থাকা অবস্থায় হাই গিয়ার রেশিও-তে সাইক্লিং করার কারণেও অনেক সময় হাঁটুর ইনজুরিতে পড়তে হয়। তাই ইনজুরি এড়াতে রাস্তা ও অবস্থা অনুযায়ী সঠিক গিয়ার ব্যবহার করুন।
  • ঘাড়ে ব্যাথা- অনেক সাইক্লিস্টদেরই ঘাড়ে ব্যাথা হয়ে থাকে। বিশেষ করে অনেক্ষণ টানা সাইকেল চালানোর ফলে এই ব্যাথা হয়। তাছাড়া বার বার পেছনে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে গিয়েও ঘাড়ে ব্যাথা হতে পারে।
    সমাধান- সাইকেল চালানোর সময় ঘাড় নুইয়ে রেখে চালাবেন না। মাথা সোজা রেখে সাইকেল চালান, তাতে ঘাড়ে প্রেশার পরবে না। পেছনে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখার বিকল্প হিসেবে সাইকেলে রিয়ার ভিউ মিরর ব্যবহার করুন।
    অনেক সময় হ্যান্ডেলবার নিচু থাকলে সামনে দেখার জন্য ঘাড়ে প্রেশার পড়তে পারে। এরকম কিছু হলে হ্যান্ডেলবার উঁচু করে দেখতে পারেন।
  • কোমরে ব্যাথা- এই ধরনের ইনজুরিও বেশিরভাগ নতুন সাইক্লিস্টদের মধ্যেই দেখা যায়। টানা অনেক্ষন সাইকেল চালানোর ফলে কিংবা ভুল রাইডিং পজিশনের কারণে কোমরে প্রচন্ড ব্যাথা দেখা দিতে পারে।
    সমাধান- যদি দেখেন টানা অনেক্ষন সাইকেল চালানোর ক্ষেত্রে আপনি কোমরে ব্যাথা পাচ্ছেন, তাহলে অভ্যাস করুন ব্রেক নিয়ে নিয়ে সাইকেল চালাতে। এরকম অবস্থায় লং রাইড পরিহার করুন, এবং অভ্যাস হওয়ার আগ পর্যন্ত ছোট খাটো রাইড দিয়ে শরীরকে অভ্যস্থ করুন।
    কুঁজো হয়ে সাইকেল চালানো ব্যাক পেইন এর অন্যতম কারণ। তাই সব সময় চেষ্টা করুন মেরুদন্ড সোজা রেখে চালানোর। তাছাড়া কোমর ও পেটের পেশির শক্তি বাড়াতে নিয়মিত ব্যায়াম করুন।

বাইসাইকেল ইনজুরি, সঠিক পজিশন
মাউন্টেন বাইক চালানোর সঠিক পজিশন
  • হাত ব্যাথা ও অবশ হয়ে যাওয়া- টানা সাইকেল চালানোর ফলে হাতের পেশিতে ব্যাথা হতে পারে, অনেক ক্ষেত্রে হাত অবশ হয়ে যেতে পারে। তাছাড়া হ্যান্ডেলবার সিট থেকে বেশি দূরে থাকার ফলে হাতের ওপর অতিরিক্ত ওজন পড়ে, যার ফলে হাতে ব্যাথা হতে পারে।
    সমাধান- হ্যান্ডেলবারে হাত এমনভাবে রাখুন যেন হাতের কব্জি বাঁকা অবস্থায় না থাকে। একই সাথে খেয়াল রাখুন যেন কনুই যেন হালকা বেন্ড অবস্থায় থাকে। কনুই কখনোই একদম সোজা এবং লক করে রাখবেন না। অন্যথায় ভাঙ্গা রাস্তায় কিংবা স্পিড ব্রেকারে ঝাঁকুনির সাথে কনুই ইনজুরি হতে পারে।
    টানা একই পজিশনে রাইডিং না করে বরং একটু পর পর হাতের পজিশন পরিবর্তন করে চালান। এক্ষেত্রে রিলাক্স মোডে হাত রাখার জন্য হ্যান্ডেলবারে এক্সট্রা বার (রেস্ট বার) লাগাতে পারেন।
    হ্যান্ডেলবার যদি বেশি দূরে মনে হয় তাহলে বারটি একটু উঁচু করে দেখতে পারেন সমাধান হয় কি না।

বাইসাইকেলে সঠিকভাবে হ্যান্ডেলবার ধরার পজিশন


  • উরুসন্ধিতে ব্যাথা ও অবশ হয়ে যাওয়া- বেশিরভাগ ছেলেরাই এই জিনিসটা বুঝতে পারবেন। সাধারণত উরুসন্ধি এলাকায় রক্ত চলাচলে বাধা সৃষ্টি হলে ব্যাথা ও অবশ হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটতে পারে।
    সমাধান- টানা সাইকেল না চালিয়ে রেস্ট নিয়ে নিয়ে চালান। লং রাইডের ক্ষেত্রে সিট কাভার ব্যবহার করুন। তাছাড়া সাইক্লিং এর জন্য বিশেষভাবে তৈরী আন্ডারওয়্যার ব্যবহার করেও উরুসন্ধির ব্যাথা থেকে রক্ষা পেতে পারেন।
এরপরও যদি সাইকেল চালানোর সময় শরীরে ব্যাথা করে, তাহলে আপনার হাইট অনুযায়ী সাইকেলের ফ্রেম সাইজ ঠিক আছে কি না দেখে নিন।


এক্সিডেন্ট কিংবা ইনজুরি-তে পড়লে কি করবেন?

সব ধরনের সাবধানতা অবলম্বনের পরও আপনি এক্সিডেন্ট কিংবা অন্যান্য ইনজুরিতে পড়তে পারেন। তাই জেনে রাখা ভালো যদি দূর্ভ্যাগ্যবসত ইনজুরিতে পড়েও যান, তাহলে কী করবেন-
  • মাথায় যদি আঘাত লাগে এবং যদি বমি বমি ভাব হয় কিংবা বমি হয়, দ্রুত ডাক্তারের কাছে যান। এটি ব্রেইনে ইন্টার্নাল ব্লিডিং এর লক্ষণ।
  • এক্সিডেন্টের পর যদি চোখে ঝাপসা দেখেন, কিংবা মাথায় ঘোরা থাকে, তাহলেও ডাক্তারের সরণাপন্ন হোন।
  • জোরে শ্বাস নিন। সাধারণত পাজরের হাড়ে ব্যাথা পেলে কিংবা কোন ফাটল দেখা দিলে গভীর নিশ্বাস নিতে গেলে বুকে ব্যাথা করবে।
  • খুব সিরিয়াস এক্সিডেন্টের মুখোমুখি হলে কখনো কখনো মেরুদন্ডে আঘাত লাগতে পারে। এ ক্ষেত্রে ঘাড় নাড়াতে অসুবিধা থেকে শুরু করে হাত পা অবশ হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটতে পারে। যদি এরকম কোন লক্ষণ দেখা দেয় তাহলে জোর করে হাত-পা কিংবা ঘাড় নাড়ানো থেকে বিরত থাকুন এবং অন্যের সাহায্য নিয়ে দ্রুততম সময়ে ডাক্তারের কাছে যান।
  • রাইডিং পজিশন এর কারণে পেশি কিংবা লিগামেন্ট ইনজুরি হলে প্রাথমিক ভাবে ম্যাসাজ ও ব্যায়াম এর মাধমে সেরে ওঠার চেষ্টা করুন। একই সাথে শরীরকে যথেষ্ট রেস্ট দিন। এর পরও যদি সমস্যা হয় তাহলে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।

সুস্বাস্থ্যের জন্য বাইসাইকেল একটি অতুলনীয় মাধ্যম। কিন্তু আমাদের খেয়াল রাখতে হবে যাতে এটি আমাদের জীবনে অভিসাপ হয়ে আসতে না পারে। তাই ট্রাফিক আইন মেনে সাবধানতার সাথে সাইকেল চালাবেন। হেলমেট ছাড়া কোন অবস্থাতেই সাইকেল চালাবেন না।

Post a Comment

0 Comments